চকরিয়া টাইমস :
মানুষের জীবনে চলার পথে আসে নানা ধরনের বাধা। কিন্তু তাই বলে কি জীবন থেমে থাকবে! এমন অনেকেই আছেন যারা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যান সামনের দিকে। অর্জন করেন সফলতা। একজন সংগ্রামী অপ্রতিরোধ্য নারীর নামই হচ্ছে তামান্না। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক অপরাজিতা তামান্না। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে তামান্না তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা তৈরি করেছেন। তামান্না সব ধরনের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সফল হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সমাজে অপরাজিতা নামে। অবহেলিত তামান্না এখন সমাজে সর্বজনে প্রশংসার পাত্র হিসেবে পরিচিত।
কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের পূর্ব ভোমাংখিল গ্রামে ১ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ সালে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয় মোছাম্মৎ তামান্নার। মাত্র নবম শ্রেণীতে পড়াবস্থায় তার বিয়ে হয়। তবে লেখাপড়ার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ থাকায় স্বামীর সহযোগীতায় ১৯৯৯ সালে গর্জনিয়া ইসলামীয়া আলিম মাদরাসা থেকে অনেক বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে দাখিল পাস করেন। সেই সময়ে দাখিল পাশ করা তিনিই ওই এলাকার একজন শিক্ষিত নারী। কারণ তখনকার সময়ে ওই এলাকায় শিক্ষা বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রতি মানুষের ভ্রান্ত ধারণা ছিল। তিনি বর্তমানে তিন সন্তানের জননী। একজন শিক্ষিত মা হওয়ায় তিন সন্তানকেই শিক্ষিত করতে পেরেছেন। তিনি অনেক সংগ্রাম করে গড়ে উঠেছেন। অভাব-অনটন দুর করে পরিবারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য ২০০২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন এনজিওতে চাকরি করেন। বিভিন্ন এলাকায় বিচরণ করে লক্ষ্য করেন তার প্রতিবেশীরা প্রতিনিয়ত কারণে অকারণে নারীদের নির্যাতন করছেন। তিনি চিন্তা করেন কীভাবে এই নির্যাতন থেকে নারীদেরকে মুক্তি করা যায়। পাশাপাশি তার মত নারীদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা যায়। নারীদের অধিকার নিয়ে তিনি কাজ করবেন। কিন্তু তিনি জানতো না যে অধিকার কী, কোথায় গেলে তার সঠিক বিচার পাবে। এই সমস্ত বিষয় জানার জন্য তিনি ২০১২সালে অপরাজিতা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রকল্পে যুক্ত হন। তখন তিনি এনজিও এর সহযোগীতায় গ্রামের দরিদ্র পরিবারকে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, মশারি, গভীর ও অগভীর নলকূপ এবং নিরাপদ পানির ট্যাপ বিনামূল্যে বিতরণ করেন। পাশাপাশি তিনি গর্ভবর্তী নারী ও কিশোরীদের সাথে স্বাস্থ্য সচেতন বিষয়ে নিয়মিত উঠান বৈঠক করেন। তার এসব কার্যক্রমের ফলে তিনি অল্প সময়ে তার এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। প্রকল্প থেকে বাস্তবায়িত সকল সভা ও প্রশিক্ষণে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। এসব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার ফলে, তামান্না অনেকগুলি পদক্ষেপের ফলে ২০১৬ সালে তিনি কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনে ইউপি নির্বাচন করেন এবং বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করেন। হয়ে উঠেন নিজ এলাকায় একজন যোগ্য সমাজসেবক। যার ফলে তিনি নিজ প্রচেষ্টায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতায় তিনটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেন, ১৪৫টি উঠান বৈঠক করেন, ৩২ জনকে বয়স্ক ভাতা, ৯ জনকে বিধবা ভাতা, ১১ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতা, সাত জনকে মাতৃত্বকালীন ভাতা, ৭৫টি পারিবারিক বিরোধ নিরসন, ৬ হাজারেরও বেশী লোককে সরকারি হট লিংক নং ৯৯৯ ও ১০৯ কল করতে সচেতন করেন।
মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সহজ করতে তার এই মহৎ উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত। তার এই কার্যক্রমের ফলে এলাকায় অনেকটা নারী নির্যাতন ও বাল্য বিবাহ কমে এসেছে। এইসব কাজ করার পেছনে তার দক্ষতা আরো বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় নিজেকে একজন বড় মানের নারী নেত্রী হিসেবে স্থাপন করার ইচ্ছা এবং সামাজিক উন্নয়নে তার যোগদান রাজনৈতিক ক্ষমতার মূর্তপ্রতিক হয়েছে, তিনি বর্তমানে ইউনিয়ন অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সভাপতি, উপজেলা অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি ও জেলা অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাছাড়াও তিনি কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন বিএনপি মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা। ইউনিয়ন দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য। গ্রামের নারীদের নিয়ে তিনি সংগঠন তৈরী করেছেন তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সভাপতি, এক্সিলেন্ট ওয়াল্ড এর মার্কেটিং অফিসার, বড় জুমছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য ও দক্ষিণ কচ্চপিয়া হাজিপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার সাফল্যের মূলমন্ত্র হিসেবে অপরাজিতা প্রকল্পকে মনে করেন। তিনি আগামীতে ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ আসন নির্বাচন করবেন। তার মানবিক এবং সমাজসেবা এক নতুন সমাজের নির্মাণে তার মৌলধর অসামান্য অবদান রয়েছে।
এব্যাপারে মোছাম্মৎ তামান্না বলেন, সংসারের অভাব-অনটনের পাশাপাশি অপরাজিতা প্রকল্প আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আমাকে সামনের দিকে নিয়ে গেছে। একসময় আমি যাদের কাছে ছিলাম অবহেলিত, আজ তারাই আমার কাজের প্রশংসা করছে। অসীম সাহসের সাথে জীবনের সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। সকল চ্যালেঞ্জ ও অপ্রতিকূল পরিবেশে আমি অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করেছি।
0 comments: