নিজস্ব প্রতিবেদক:
ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত পরিশ্রমী একজন নারী ফিরোজা হাকিম। তিনি অনুধাবন করতে পারেন নারীকে স্বাবলম্বী হতে হলে বিভিন্ন কাজ জানতে করতে হবে। তাই তিনি বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি এসে, শ্বশুর, শাশুড়ি ও স্বামীর সাথে পরামর্শক্রমে আত্মনির্ভরশীল বিভিন্ন কাজের উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেন। যাতে কারো দ্বারস্থ হতে না হয়। সমাজে নিজের অবস্থানকে সমুন্নত রাখতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান অপ্রতিরোধ্য ফিরোজা হাকিম।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যুগ যুগ ধরে নারীরা নানা বঞ্চনার শিকার। অসংখ্য প্রতিকূল সময় পাড়ি দিতে হয় নারীদের। এ সমাজে নারীদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। তবে সকল সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নারীরা এখন মাথা উচু করে দাঁড়াবার কল্যাণমুখী কৌশল রপ্ত করেছে। নারীরা হিমালয়ও জয় করেছে; অভিযানে যাচ্ছেন মহাকাশে। এছাড়া নিজ মেধা ও পরিশ্রমে দেশের নারীরাও হয়ে উঠছেন অপরাজিতা। একজন নারী হিসেবে ফিরোজা হাকিম তার অনন্য উদাহরণ। সমাজের অবহেলিত অসংখ্য নারীদের অনুপ্রেরণা যোগাবে ফিরোজা হাকিমের অপরাজিতা হবার সফলতার নেপথ্যে গুচ্ছগল্পগুলো।
তিনি নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আনসার ভিডিপির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রাণিসম্পদ থেকে হাঁস মুরগী পালনের উপর উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং মৎস্য অধিদপ্তর থেকে মৎস্য চাষের উপর প্রশিক্ষণ নেন। ব্র্যাক থেকে স্বাস্থ্য সেবিকার প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাস্থ্য সেবিকার কাজ শুরু করেন। এছাড়া যুব উন্নয়ন থেকে হস্তশিল্প ও গবাদিপশু পালনের উপর প্রশিক্ষণ করেন, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ বিউটিশিয়ান ও ব্লক বাটিকের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি ২০১৬ সালে সাহারবিল ইউনিয়নে সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচন করেন এবং কালো টাকা ও পেশী শক্তির কাছে তিনি হেরে যান। ২০১৯ সালে অপরাজিতা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রকল্পে যুক্ত হন। অপরাজিতার সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ইউনিয়ন অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি উপজেলা অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
ফিরোজা হাকিম নানাবিধ প্রশিক্ষণ গ্রহণের ফলে তিনি নিজেই একটি সাহারবিল নারীকল্যাণ সংঘ নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত। তিনি অনুধাবন করেন যে নারীরা শুধু সংসার ও সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন এবং পরিবারের সদস্য দ্বারা নির্যাতিত হন, পরিবার ও সমাজে তারা কোন অবদানকে মূল্যায়ন কওে না। তাদের সেই বিভীষিকার জীবন মুছে দেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । বর্তমানে তার নারী কল্যাণ সংগঠনে ৪০জন নারী ব্লক বাটিক ও হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সেখানে তিনি প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তার সংগঠন থেকে এ পর্যন্ত ২হাজারের বেশি নারী বিভিন্ন কাজের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
ফিরোজা হাকিম একজন উদার মনের মানুষ। এ সংগঠন থেকে গরীব ও অসহায় নারীদের প্রশিক্ষণের জন্য নেয়া হয় না কোন টাকা । তার এ জীবনযাত্রায় অনেক সফলতার গল্প লুকিয়ে আছে। তিনি নিজ উদ্যোগে তৈরি করা প্রতিষ্ঠানে ৬ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরা স্বাবলম্বী হতে পারেন। ফিরোজা হাকিম এ সকল কাজের পাশাপাশি তিনি সামাজিক কাজ, যেমন বাল্যবিবাহ বন্ধ করেন ৫টি, নারীদের বহুমুখি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে ২০টি উঠান বৈঠক করেন, পারিবারিক বিরোধ নিরসন করেন ৩০টি। তিনি নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি না হয়েও এলাকার মানুষকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা পেতে সহযোগিতা করেন, বিশেষ করে যুবদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশি যুবদের, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং আনসার ভিডিপি থেকে প্রশিক্ষণ পেতে সহযোগিতা করেন।
অপরাজিতা ফিরোজা হাকিম তিনি তার এলাকার ২৫ জন যুবদের আইসিটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে সহযোগিতা করেন। তিনি ব্যবস্থাপনার উপরে দুই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ করান ৩০ জনকে। সামাজিক কাজ করতে গিয়ে তিনি অনেক বাঁধার সম্মুখীনও হয়েছেন। কিন্তু তিনি সব বাঁধা অতিক্রম করে আপন মহিমায় সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন দুর্বার গতিতে। ফিরোজা হাকিম একজন সময়ের সাহসী নারী হিসেবেও সর্বজনের কাছে পরিচিত। তিনি ২০১৯ সালে সমাজ উন্নয়েনে অসাধারণ অবদান রেখেছেন যে নারী ক্যাটাগরিতে জয়ীতা পুরস্কার পেয়েছেন। তার সাফল্যের পেছনে তার স্বামীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অবদান রয়েছে।
ফিরোজা হাকিম বিভিন্ন সংগঠনের কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ইউনিয়ন পরিষদের পারিবারিক বিরোধ নিরসন নারী ও শিশু কল্যান স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং আর.কে নুরুল আমিন চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএমসি কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন। তিনি উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের যুবদের প্রশিক্ষণের কমিটিতে আছেন। তিনি সমাজের পিছিয়ে পরা নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। ফিরোজা হাকিমের আগামী দিনের স্বপ্ন; তিনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হিসেবে ভোট করবেন। চকরিয়া উপজেলার সর্বস্তরের জনসাধারণ ফিরোজা হাকিমকে এক নামে চিনে। তিনি সকল সময়ে সামাজিক কর্মসূচি এবং মানবিক সেবা করার জন্য নিবেদিত।
জয়িতা ফিরোজা হাকিম বলেন “নারীদের নিজেদের অধিকার অর্জনে সোচ্চার হতে হবে। অধিকার কেউ দেয় না, অর্জন করে নিতে হয়। প্রত্যেক সংগ্রামী নারী একজন অপরাজিতা। তিনি বলেন, অনেকের সংগ্রামের গল্প ভিন্ন হতে পারে; কিন্তু কমবেশি সব নারীর সংগ্রাম একই। অপরাজিতা মানে বিজয়ী। পরাজয়ে ভেঙ্গে না পড়ে অদম্য মনোবলে প্রতিকূলতা পেরিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নারীরাই অপরাজিতা। প্রতিকূলতা, নির্যাতন, অবহেলা পেরিয়ে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিতদের সংগ্রামের করুণ গল্প জেন্ডার বৈষম্যহীন সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে হলে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই”।
0 comments: